ভিনগ্রহের ডাইনোসর


আখতারুল ইসলাম

মিঠুর বেড়ালের নাম কিটু। বিড়ালটি তার খেলার সঙ্গি। বিশাল ঢাকা শহরে মিঠুর জন্য সবুজ শ্যামল এক টুকরা খেলার মাঠ নেই। মাঠ বলতে এই চার দেয়ালের ঘরের ফ্লোর আর বিল্ডিংয়ের ছাদ। ছাদে অবশ্য বিভিন্ন ফুল-ফলের চারা লাগাতেই যেটুকু জায়গা ছিল তাও কমতে কমতে ঘরের ফ্লোরের মতো এক চিলতে হয়ে দাঁড়িয়ে। তবু তার খেলা বলতেই বাসার ফ্লোর আর এই ছাদই সম্বল। কখনো-সখনো বাবা-মা পার্কে নিয়ে যায়। তাও বছরে এক বা দুবার। কারণ তারা চাকরি নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে যে একমাত্র ছেলেকে যে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবে মুক্ত বাতাসে সে সময়টুকু হয়ে উঠে না। অন্য খেলার সঙ্গী না থাকায় পোষা কিটুই তার একমাত্র বন্ধু! যদিও ঘরে একটা কাজের মানুষ আছে। তার সাথে মিঠুর বনিবনা কম হয় বলে খেলতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু কিটুর মন খারাপ হলে বাধ্য হয়ে কাজের বুয়া বুলবুলির সাথে খেলে।
মিঠু ক্লাস ফোরে পড়ে। ইশকুলের স্যার একটা নৌকা এঁকে নিতে বলেছে! মিঠু নৌকা আঁকছে জল রং দিয়ে। কোত্থেকে কিটু দৌড়ে এসে রঙের পে­টটা উল্টে দিলে, রঙ ছিটকে অদ্ভুত এক নদীর দৃশ্য হয়ে যায়। মিঠু রেগে যায়! এই কিটু কি করলি? দিলি তো সব শেষ করে।
কিটু ম্যাঁও ম্যাঁও করে লেজ নেড়ে দোষ স্বীকার করার মতো সামনে পা দু’ভেঙে অদূরে বসে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে।
রেগে মিঠু স্কেল নিয়ে বলে, এই কিটু দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা! আজ তোকে শেষ করে ফেলব! কিটু দৌড়ে গিয়ে মিঠুর কম্পিউটারের টেবিলে লাফ দিয়ে ওঠে। কম্পিউটার খোলা ছিল, কিবোর্ডে চাপ পড়তেই অদ্ভুত একটা প্রাণীর ছবি ভেসে ওঠে। ছবিটি চোখে পড়তেই মিঠু ওয়াও করে ওঠে! ভুলে যায় কিটুকে শাস্তি দেওয়ার কথা।
কিটু লুকিয়ে থাকে টেবিলের নিচে। ছবি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে মিঠু হারিয়ে যায়
কম্পিউটারের গেইম! নেট। মিঠু সব করতে পারে। মিঠুর মা ইশকুল টিচার চারটায় বাসায় ফিরে এলে রং করা ছবি দেখে বলল, মিঠু! কই, কিসব করে রেখেছিস।
মা, আমি না কিটু!
কিটু এতো সুন্দর ছবি আঁকলো।
হ্যাঁ মা!
আমি নৌকা আঁকতেই ও সব রঙ ঢেলে দেয় অমনি চমৎকার ছবি হয়ে যায়।
সুন্দর না মা! ওকে যখন আমি দৌড়াতে যাই ও দৌড়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডে টিপ দিয়ে একটু নতুন ছবি এনে দেয়!
কই দেখি মিঠু!
এই দেখো!
মা কম্পিউটারের কাছে গিয়ে দেখে অদ্ভুত এক প্রাণীর ছবি।
ডাইনোসরের মতো বন বিড়াল প্রকৃতির!
কিটু লেজ নাড়তে নাড়তে মিঠুর আশে পাশে ম্যাঁও! ম্যাঁও করে ঘুর ঘুর করছে!
মিঠু ওকে কোলে নিয়ে মাকে বলে, মা কিটুকে কম্পিউটার শেখালে কেমন হয়!
কি বলছিস মিঠু!
হ্যাঁ মা! ও পারবে, ওর অনেক বুদ্ধি!
এটা শোনাতে কিটু ম্যাঁও ম্যাঁও করে মাথা নাড়ে।
রাতে মিঠু আর কিটু একসাথে ঘুমায়।
কিটু ডাকছে, এই মিঠু! মিঠু! ওঠো।
মিঠু উঠে বলল, কী হয়েছে, ডাকছো কেন?
আমি কম্পিউটারে যে ছবিটা এঁকে দিয়েছিলাম, সেই প্রাণীটা এসেছে। তোমার সাথে কথা বলতে।
কিটুর কথায় মিঠু বলছে, কই! ওর নাম
পিটোসরা। পড়ার চেয়ারে বসে পিটোসরা বলল, শোন মিঠু! আজ থেকে আমরা বন্ধু! মিঠু বলল, ঠিক আছে। কিন্তু পিটোসরা তুমি কোথায় থাকো?
ঐ যে আকাশ দেখছো, সেখানে অনেক গ্রহ-ন¶ত্র থাকে, পৃথিবীর মতো অনেক পৃথিবী থাকে, এই পৃথিবী থেকে ১ ল¶ আলোক বর্ষ দূরে
‘ডাইনোসিয়া’ নামে একটা গ্রহ আছে আমরা সেখানে থাকি!
মিঠুর ছোট মাথায় আলোকবর্ষ, গ্রহ-ন¶ত্র কিছুই ঢোকে না, বুঝতেও পারে না। তবু টিভি ও কম্পিউটারে অনেক কিছু দেখে কিছুটা ধারণা সে পায়।
কিটু বলল, শোন মিঠু ও আমার পূর্ব পুরুষ! বংশধর!
মিঠু অবাক হয় কিটুর কথায়।
মানে!
শোন, এক সময় পৃথিবীতে ডাইনোসর নামক প্রাণীরা বাস করত, কোটি কোটি বছর আগে? কিন্তু তার এখন বেঁচে নেই! পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই প্রাণীরা কিন্তু তাদের বিভিন্ন ফসিল, কংকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শিলাস্তরে পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয় ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে ট্রিয়াসিক যুগ থেকে
ক্রিটোসিয়াস যুগের শেষে ওরা পৃথিবীতে বাস করে আসছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানান কারণে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই ধরনের ডাইনোসর ছিল আর্চাইযুপটেরিক্স, যার পাখির মতো ডানা ছিল উড়তে পাড়তো। যাকে আদিম যুগের পাখি বলা হত। পৃথিবীর এমন অবস্থা দেখে এখন তারা পাড়ি জমায় অন্য গ্রহে। তারা আমার পূর্ব পুরুষ, পিটোসরা।
মিঠু বলল, তোমরা কেন এসেছো পৃথিবীতে?
পিটোসরা বলল, আমি এসেছি আমার পূর্ব পুরুষের জীবাশ্ম! কঙ্কাল! হাড় থেকে ক্লোনিং এর মাধ্যমে পৃথিবীতে আবার ডাইনোসরের আবির্ভাব ঘটাতে।
মিঠু বলল, কোথায় থাকে জীবাশ্ম?
কিটু বলল, কানাডা, চীন, কেনিয়া, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে!
মিঠু বলল, আচ্ছা, আমার কাছে কেন এসেছো? পিটোসরা বলল, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি!
মানে?
মানে তোমাকে আমাদের নানা কাজে লাগবে।
ভয়ে মিঠুর হাত পা কাঁপতে থাকে। গলা শুকিয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করে। শরীর হিম ঠান্ডা হয়ে লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। বলল, না আমি যাব না। আমি যাব না, আমি যাব না, আমি যাব না। আমাকে নিও না। আব্বু আম্মু চিন্তা করবে। আমি স্কুলে যাব। তোমাদের সাথে যাব না।
গোঁ গোঁ শব্দে কান্না করতে করতে বলছে, আমি যাব না… যাব না।
পাশের রুম থেকে বাবা মা ছুটে আসে।
মিঠু! মিঠু! এই মিঠু কি হয়েছে বাবা?
না, আমি যাব না, আমি যাব না।
ওঠ বাবা সকাল হয়েছে। কোথায় যাবে না? আজ স্কুল বন্ধ, শুক্রবার। স্কুল যেতে হবে না।
মা মিঠুর গায়ে হাত দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। হঠাৎ চোখ মুখ কচলাতে কচলাতে মিঠু ঘুম থেকে ওঠে। বাবা বাবা!
বাবা বলল, কি হয়েছে মিঠু? তুমি কোথায় যাবে না বলছো?
বাবা, কিটু কই? আর ডাইনোসরটা!

কোথায় ডাইনোসর?

কেন? বাবা, পিটোসরা! যে আমাকে ওদের গ্রহে নিতে এসেছিল।
ছেলের আবোল তাবোল এসব কথা শুনে মা বাবা দু’জনই অবাক।
বাবা কিটু কই?
কেন? আছে হয়তো। কোথাও কিছু খাচ্ছে।
না বাবা, বলে মিঠু কিটুকে এ ঘর ও ঘর খুঁজে কোথাও পাচ্ছে না। খাট, সোফা, টেবিলের নিচে খোঁজে! বাবা-মাও তার সাথে খুঁজেও পেল না।
কোথায় যেতে পারে কিটু!
বাবা বলল, মিঠু কিটু কোথায়?
মিঠু বাবা মাকে রাতের ঘটনাটা খুলে বলে।
তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। বলছে, এটা তোমার স্বপ্ন। কোথা থেকে আসবে ডাইনোসর!
মিঠু বলল, ঠিক আছে। যদি স্বপ্নই হবে তবে আমাদের কিটু কোথায়? ওতো আমাকে ছাড়া থাকে না।
বাবা বলল, সত্যিই তো!
দিন যায় রাত আসে কিন্তু মিঠুর বন্ধু কিটু আর আসে না। কোনো বিড়াল দেখলেই মিঠু কিটু কিটু বলে ডাকে, কিন্তু ওরা লেজ তুলে দৌড়ে পালায়।

কোন মন্তব্য নেই: