মুক্তিযুদ্ধে নারীর এবং মূল্যায়ন - জাজাফী



মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এই বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যম-িত করেছেন, তাদের অনেকের নাম এখনো অজানা। মুমাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চপাস্ট, অস্ত্রচালনা, ফাস্টএইড, ট্রেঞ্চ করা ও আত্মরক্ষার নানা কৌশলÑ এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে ধাপে ধাপেÑ যেখানে নারীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বিদ্যমান।


নারীর অবদান বলতে গেলে একমাত্র লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে অনেকটাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের লেখক চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। নির্যাতনের শিকার অনেক নারীর মতো যুদ্ধের পর স্বামীগৃহে তার ঠাঁই মেলেনি। যুদ্ধকালে যেসব নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল। স্বামীহারা বিধবাদের দরকার ছিল আশ্রয়। এসবই তখন বড় করে দেখা হয়েছে। এর পাশাপাশি ১৯৭১ সালের নারী নির্যাতনকে বীরত্বের মহিমা দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছে রাষ্ট্র। ফলে নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে।স্বাধীনতার ২৯ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ অবদানের স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন নারীরা। এর ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ বিস্মৃতি ও অবহেলা শেষে ইতিহাস এখন বদলাতে শুরু করেছে। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিনজন। ১৯৭২ সালে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, এর পর তারামন বিবি ১৯৭৩ সালে ও ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন কাঁকন বিবি। এ ছাড়া সম্মুখযুদ্ধে যেসব নারীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা জানা যায়Ñ তাদের মধ্যে ক্যাম্পকর্মী বেনিলাল দাসগুপ্ত, শোভারানী ম-ল, কাঁকন বিবি, শিরিন বানু, বীথিকা বিশ্বাস, মিনারা বেগম ঝুনু, গীতশ্রী চৌধুরী, আলেয়া বেগম, ফেরদৌস আরা বেগম, আশালতা বৈদ্য, রওশন আরা বেগম, জিন্নাত আরা, করুণা বেগম, মেহেরুন্নেসা মিরা প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ মুক্তিযুদ্ধে নারী মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন। তিনি ছাড়াও গীতা রানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধা রানী কর, মঞ্জু দেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়ার রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা ও শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। এসব কাজে বেগম মুশতারী শফী, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রীনা খান প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। তারামন বিবি বীরপ্রতীক মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাঁধুনি হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি ১৪ বছরের কিশোরী। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠি ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন। রাতের বেলা পাকিস্তানি সেনা শিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাঁড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকিস্তানি সেনা শিবিরে হামলা চালায়। একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্রচালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এক সময় পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলেছিল ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। এক সপ্তাহ অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীতে করুণা বেগম অন্য নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই বাহিনীর অধীন ৫০ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডে ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পিরোজপুর জেলার ‘অপারেশন স্বরূপকাঠি’ বাহিনীর অকুতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোট। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপানার সঙ্গে মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। ভাবনার বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে হাজারো মেয়ে ট্রেনিং নিয়েছেন যুদ্ধ করেছেন। অথচ তালিকাভুক্ত নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ২০৯ জন! পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

কোন মন্তব্য নেই: